সংবাদ সারাদেশ

আজ নুসরাত হত্যার ৩ বছরঃ অপপ্রচারে আতঙ্কিত পরিবার

ফেনী প্রতিনিধিঃ

২০১৯ সালের ১০ এপ্রিল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু বরণ করেন ফেনীর সোনাগাজী আলোচিত ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার পরীক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফি।

পরীক্ষাকেন্দ্রে আলিম পরীক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফির গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে হত্যার তিন বছর পূর্ণ হলো আজ। এই মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে নুসরাতের পরিবারের পক্ষ থেকে বাড়িতে কোরআন খতম, মিলাদ, দোয়া ও ইফতার মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে।

হাসপাতালের বেডে মৃত্যুশয্যায় থেকেও খুনিদের বিচার চেয়েছিলেন নুসরাত।

এই নিয়ে বিজ্ঞাপন বিচারও হয়েছে। ২০১৯ সালের ২৪ অক্টোবর ১৬ আামির মৃত্যুদণ্ডের আদেশও দিয়েছিলেন বিচারিক আদালত। আসামিদের পক্ষ থেকে উচ্চ আদালতে আপিলও করা হয়েছে। কিন্তু করোনাভাইরাস মহামারির কারণে আটকে আছে আপিল শুনানি।

এদিকে উচ্চ আদলতেও ফাঁসির আদেশ বহাল চেয়ে আসামিদের ফাঁসির প্রহর গুনছে তার পরিবার। নুসরাতের তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে গতকাল শনিবার সকালে তার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, দুজন পুলিশ পাহারায় রয়েছে নুসরাতের বাড়িতে। তার মা শিরিনা আক্তারের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, আজকে তিনটি বছর নির্ঘুম রাত পার করছি। মেয়ের মোবার ঘরেই আমি ঘুমাই। মেয়ের মৃত্যু যন্ত্রণার সেই চারটি দিন ছিল আমার কাছে বিভীষিকার। সেই ভয়াল দিনগুলো আমার চোখে ভেসে আসলে আর ঘুমাতে পারি না। নুসরাতের শূন্যতা কিছুতেই পূরণ হওয়ার নয়। আমার পরিবারের সদস্যদের সেই দিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বুকে টেনে ন্যায়বিচারের আশ্বাস দিয়েছিলেন। আমরা বিচারিক আদালতে ন্যায়বিচার পেয়েছি। আমি শতভাগ আশাবাদী উচ্চ আদালতেও আসামিদের ফাঁসির আদেশ বহাল থাকবে। আমরা আসামিদে ফাঁসি কার্যকরের প্রহর গুনছি। উচ্চ আদালতে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হলে আমার মেয়ের আত্মা শান্তি পাবে।  

তিনি আরো বলেন, নুসরাতের মৃত্যুর পর বিভিন্ন মাধ্যম থেকে নুসরাতের স্মৃতিরক্ষায় উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলা হলেও সরকারি-বেসরকারি কোনো মাধ্যম থেকে আজ পর্যন্ত তার স্মৃতিরক্ষায় উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। সে যে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে তার জন্য মরণোত্তর কোনো স্বীকৃতিও প্রদান করা হয়নি।

২০১৯ সালে দেশজুড়ে অন্যতম আলোচিত ঘটনা ছিল ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসায় পরীক্ষা কেন্দ্রের ভেতরে আলিম পরীক্ষার্থী ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনা। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে শিরোনাম হয়ে কাঁপিয়ে দিয়েছিল নৃশংস এ হত্যাকাণ্ড।

ঘটনার শুরু ওই বছরের ২৭ মার্চ। ওই দিন সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসার নিজ অফিস কক্ষে ডেকে রাফিকে যৌন হয়রানি করেন অধ্যক্ষ সিরাজউদদৌলা। এ ঘটনায় তাঁর বিরুদ্ধে সোনাগাজী মডেল থানায় মামলা করেন নুসরাতের মা শিরিন আখতার। ওই দিনই স্থানীয়দের সহায়তায় অধ্যক্ষকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এর পর সিরাজকে জেল থেকে বের করে আনার জন্য ও মামলা তুলে নিতে তার অনুগতরা নুসরাত জাহান রাফি ও তার পরিবারকে নানাভাবে চাপ দিতে থাকে।

৬ এপ্রিল পরীক্ষা দিতে গেলে সিরাজের লোকজন নুসরাতকে মাদরাসার সাইক্লোন শেল্টারের ছাদে ডেকে নেয়। মামলা তুলে নিতে চাপ দিলে সে অস্বীকার করে। এ সময় হাত-পা বেঁধে তার গায়ে আগুন ধরিয়ে দিয়ে সন্ত্রাসীরা সরে পড়ে। তার চিৎকারে ঘটনাস্থল থেকে তাকে উদ্ধার করে প্রথমে সোনাগাজী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়। এরপর তাকে স্থানান্তর করা হয় ফেনী ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে। অবস্থা সঙ্কটাপন্ন হওয়ায় সেখান থেকে নুসরাতকে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে।

বর্বরোচিত এ ঘটনায় নিন্দার ঝড় ওঠে। পরিকল্পিত এ হত্যাকাণ্ডটিকে শুরু থেকে আত্মহত্যা বলে চালাতে চান থানার ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে মামলাটি পিবিআইতে হস্তান্তর করা হয়। গণমাধ্যমের দৃঢ় অবস্থান এবং পিবিআইর তদন্তে প্রকৃত রহস্য বেরিয়ে আসতে থাকে। এ ঘটনায় নুসরাতের ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান ২০১৯ সালের ৮ এপ্রিল মামলা দায়ের করেন। এই মামলায় ২৮ মে অভিযোগপত্র দাখিলের পর ২০ জুন অভিযোগ গঠন করেন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল। পরে সাক্ষ্যগ্রহণ ও যুক্তিতর্ক শেষে ৩০ সেপ্টেম্বর আদালত রায়ের জন্য ২৪ অক্টোবর নির্ধারণ করেন।  

মামলাটিতে মাত্র ৬১ কার্যদিবসে ৮৭ সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ ও যুক্ততর্ক গ্রহণ করা হয়। একই বছরের ২৪ অক্টোবর মামলার অভিযোগপত্রে অন্তর্ভুক্ত ১৬ আসামির সবাইকে মৃত্যুদণ্ড দেন ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মামুনুর রশিদ। পাশাপাশি প্রত্যেক আসামিকে এক লাখ টাকা করে অর্থদণ্ড করেন।

দণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসার তৎকালীন অধ্যক্ষ এস এম সিরাজ উদ-দৌলা (৫৭), উপজেলা আওয়ামী লীগ সাবেক সভাপতি ও মাদরাসার গভর্নিং কমিটির তৎকালীন সহসভাপতি রুহুল আমিন, মাদরাসা শাখা ছাত্রলীগ সভাপতি শাহাদাত হোসেন শামীম (২০), কাউন্সিলর ও সোনাগাজী পৌর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাকসুদ আলম (৫০), নুরউদ্দিন (২৩), সাইফুর রহমান মোহাম্মদ জোবায়ের (২১), জাবেদ হোসেন ওরফে সাখাওয়াত হোসেন (১৯), হাফেজ আব্দুল কাদের (২৫), প্রভাষক আবছার উদ্দিন (৩৩), কামরুন নাহার মনি (১৯), উম্মে সুলতানা পপি (১৯), আব্দুর রহিম শরীফ (২০), ইফতেখার উদ্দিন রানা (২২), ইমরান হোসেন মামুন (২২),মোহাম্মদ শামীম (২০) ও মহিউদ্দিন শাকিল (২০) ।

২৯ অক্টোবর আসামিদের মৃত্যুদন্ডাদেশ অনুমোদনের জন্য (ডেথ রেফারেন্স) মামলার যাবতীয় কার্যক্রম হাইকোর্টে পৌঁছে। ফৌজদারি কার্যবিধি অনুসারে বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডাদেশ হলে অনুমোদনের জন্য মামলার যাবতীয় কার্যক্রম উচ্চ আদালতে পাঠাতে হয়। সে অনুসারে ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টে আসে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পেপারবুক (মামলার যাবতীয় নথি) ছাপানো শেষ করা হয়েছিল। পরে প্রয়োজনীয় কাজ শেষে শুনানির জন্য মামলাটি প্রধান বিচারপতি বরাবর উপস্থাপন করা হয়েছিল। আপিল অগ্রাধিকারভিত্তিতে শুনানির জন্য বেঞ্চ নির্ধারণ করেছিলেন প্রধান বিচারপতি। বিচারপতি সৌমেন্দ্র সরকারের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে এ মামলার শুনানির জন্য নির্ধারণ করা হয়েছিল।

বাদীপক্ষের আইনজীবী শাহজাহান সাজু বলেন, প্রয়োজনীয় কাজ শেষে শুনানির জন্য মামলাটি প্রধান বিচারপতি বরাবর উপস্থাপন করা হয়। আপিল অগ্রাধিকারভিত্তিতে শুনানির জন্য বেঞ্চ গঠন করেছিলেন প্রধান বিচারপতি। বিচারপতি হাসান ইমাম ও সৌমেন্দ্র সরকার নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে এ মামলার শুনানির জন্য নির্ধারণ করা হয়েছিল। সে বেঞ্চ করোনার কারণে বাতিল হয়ে গেছে। বর্তমান প্রধান বিচারপতি বেঞ্চ গঠন করে দিলে আশা করছি অগ্রাধিকারভিত্তিতে আপিল মামলাটির শুনানি হবে।

এই বিষয়ে জানতে চাইলে, মামলার বাদী নুসরাত জাহান রাফির বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান বলেন, আমরা বিচারিক আদালতে ন্যায়বিচার পেয়েছি। উচ্চ আদালতেও আমরা ন্যায় বিচারপ্রত্যাশী। তিনি আরো বলেন, নুসরাতের এমন মৃত্যুর স্মৃতিরক্ষায় একটি কমপ্লেক্স নির্মাণ করার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিকট হস্তক্ষেপ কামনা করছি।  

এই ধরণের সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button